Breaking News

এমন করে তার চলে যাওয়ার কথা ছিল না

মেয়েটা চলে যাচ্ছে। এমন করে তার চলে যাওয়ার কথা ছিল না। ছেলেটা হাউমাউ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘তুমি বলেছিলা, তুমি কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবে না। কখনোই না। যদি কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যাও, তবে পৃথিবীটা সেদিন উল্টে যাবে’।
মেয়েটা কথা বলে না। ছেলেটা হাউমাউ করে কাঁদে। কাঁদতেই থাকে। কাঁদতে কাঁদতে সে কতকিছু ভাবে। কত কত স্মৃতি, কত কত মুহূর্ত, কত কত কমিটমেন্ট!
মেয়েটা সেই কান্নায় সত্যি সত্যি দ্রবীভূত হয় কি না বোঝা যায় না। তবে সে খানিকটা গভীর ভেজা গলায় বলে, ‘আর কোন উপায় ছিল না। তুমিতো জানো, আমার আর কী করার ছিল! তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে, খুব। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। কিন্তু বিয়েটা আমাকে করতেই হচ্ছে’।
ছেলেটা কথা বলে না। তার বুকের ভেতর আবারও কষ্ট দলা পাকায়। তবে সেই কষ্টে খানিক ভালো লাগাও যেন আড়ালে আবডালে কোথায় উঁকি মারে। মেয়েটা তাহলে তার সাথে প্রতারণা করে নি। সে পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতি , পরিবার তাকে বাধ্য করছে অন্য কাউকে বিয়ে করতে। কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে আসলে তাকেই ভালোবাসে!
ছেলেটার খুব সামান্য, ধরতে না পারার মত খুব সামান্য হলেও ভালো লাগে। কিন্তু কষ্টরা আরও গাঢ় হয়। আরও কান্না পায়। মেয়েটাও কাঁদে। তারা পরস্পরকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে কাঁদে। কিন্তু সেই কান্নার কার কতটুকু আসলেই কান্না, আসলেই অসহনীয় কষ্ট পুষে রাখতে না পারার নির্ভেজাল কান্না, কে জানে?
আসলেই কেউ জানে না। ‘জগতের যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে চাই, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না’ এমন কমিটমেন্টগুলো জানে না। একান্ত মুহূর্তগুলো জানে না। জানে না, অসংখ্য, রাত দিনের গল্পরাও, জানে না মোবাইল ফোন, ফেসবুকের কত শত, সহস্র মিনিট, ঘন্টা, মেগাবাইটের হিসেবেরাও।
এই গল্পের ছেলে বা মেয়ে আলাদা কেউ নয়। গল্প ভেদে চরিত্র বদলে যেতে পারে। কিন্তু যা বদলায় না তা হল, ভালোবাসা, অনুভূতি, আবেগ আর ঘটে যাওয়া ঘটনার হিসেব।
এক জনমে এমন বহু কান্না দেখেছি। হয়তো কেঁদেছিও। সেই কান্নার ফোটা ফোটা জল, বিনিদ্র রাতেরা একটা সময় একটা অদ্ভুত কঠিন সত্য বলে গেছে কানের কাছে, বুকের কাছে। সেই সত্য, ‘এখানে কেউ কারো জন্য থাকে না। সকলেই থাকে কেবলই নিজের জন্য... যতক্ষন নিজের ভালো লাগে, কারো কাছে থাকতে না পারলে বুকের ভেতর হাহাকারের তুমুল হাওয়া কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে দেয়, ততক্ষণ কেবল কেউ কারো জন্য থাকে। কিন্তু সেই অনুভুতিরা যে মরে যেতে থাকে, বিবশ হতে থাকে, পল্কা হতে থাকে, যখন কারো জন্য কারো বুকের ভেতর হাহাকার জাগে না, কান্না কান্না লাগে না, বুকের ভেতর কেঁপে কেঁপে ওঠে না, তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে সাথে না থাকার বাসনা। এই বাসনা ভয়ঙ্কর। এই না থাকতে চাওয়ার বাসনা, অনুভুতিহীনতা নিয়েও থেকে যাওয়া বরং সম্পর্কের মৃত্যু কিংবা মৃত সম্পর্কের পচে গলে যাওয়া লাশ বয়ে বেড়ানো।
তাহলে কে থাকে? শর্তবিহীন? দুঃখে, আনন্দে, বিষাদে, হর্ষে? কেউ কি থাকে?
হ্যাঁ থাকে।
কে?
কেবল নিজে। কেবল নিজেই থাকে নিজের সঙ্গে। সে কখনও নিজেকে ছেড়ে যায় না। সুতরাং সেই একটা নিজেকে গড়ে তুলতে হয় প্রবল কঠিন করে, বিশাল বিস্তৃত করে, যাতে সে ছায়াময় হয়ে উঠতে পারে। ঘোর বিপদে, বিষণ্ণতায় তার ভেতর ডূবে যাওয়া যেই। এই স্বত্বাটি ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়। নিজের ভেতর। সে তখন ভেঙে পড়া স্বত্বাটাকে গভীর মমতায়, আশ্বাসে, আশ্রয়ে আগলে রাখে।
খুবই অদ্ভুত কথা। ‘নিজ’ কি দুটো স্বত্বা? যে একটা আরেকটার সাথে থাকবে।
হ্যাঁ, ‘নিজ’ দুটো স্বত্বাই। কিংবা দুটো না তার চেয়েও আরও অনেক বেশি।
কী অদ্ভুত।
হ্যাঁ অদ্ভুত। কিন্তু সত্যি।
কিভাবে?
যেসব মানুষ দুম করে সুইসাইড করে বসে তাদের মধ্যেও কিন্তু একাধীক স্বত্বা থাকে, তাকে বলতে থাকে,সুইসাইড করো না, না, না। সে নানান যুক্তি দিতে থাকে। সুইসাইড না করার পক্ষের যুক্তি। আরেকটা স্বত্বা থাকে, সে বলতে থাকে, সুইসাইড করে ফেলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে নানান যুক্তি দিতে থাকে। এই দুইতরফেই চলতে থাকে যুক্তির খেলা। সেই খেলায় যে জেতে, সেই সফল হয়।
বেঁচে থাকা বা মৃত্যু। আত্মজীবন বা আত্মহনন।
এখানে সেই স্বত্বাটাই জেতে, যাকে আপনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, অসংখ্য অজস্র ঘটনায়, চেতনে , অবচেতনে লালন করেছেন, শক্তিশালী করেছেন, বাড়িয়ে তুলেছেন। অনেক ছোট ছোট ঘটনায়। অনেক বড় বড় ঘটনায় আপনি আপনার কোন ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, কখনও ভেবে দেখেছেন? সেই প্রাধান্য দেয়া ভাবনাগুলোই কিন্তু আপনার দুঃসময়ে আপনার পাশে থাকবে।
সমস্যা হচ্ছে, এমন নানা ঘটনায় আপনি যদি নেতিবাচক ভাবনাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, তবে আপনার দুঃসময়ে আপনার সেই নেতিবাচক ভাবনাগুলো এসে আপনার পাশে দাঁড়াবে। আর তারপর? তারপর আপনার অসহায়ত্বকে আরও প্রবল অসহায়ত্বে পরিণত করবে। আপনার দুঃসময়কে আরও প্রলম্বিত করবে। ধ্বংসাত্মক করবে। কিন্তু আপনি যদি এতোদিনকার ঘটনাগুলোয় চেতনে অবচেতনে ইতিবাচক ভাবনাগুলোকে লালন করে, তারাও এই দুঃসময়ে আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে।
এই ইতিবাচক আর নেতিবাচক ভাবনাগুলো আসলে কী? আশা করছি সবাই মোটামুটি বুঝতে পারছেন। না পারলেও পরবর্তী কোন লেখায় এই বিষয়ে আমি আমার ভাবনা শেয়ার করব।
তার আগে একটা কথা।
আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। থাকতে পারব না। আসলেই কী তাই? জগতে কী কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না? মৃত সন্তানকে ছেড়ে বাবা মা? পারেন না? নিশ্চয়ই পারেন। সেই পারা তীব্র কষ্টের। কিন্তু সেই কষ্টও ধীরে ধীরে খানিকটা করে আড়াল হতে থাকে। থাকে না? থাকে।
আসলে, ‘নাথিং ইজ ইমপারেটিভ ইন লাইফ’। জীবনে অপরিহার্য বলে কিছু নেই। যখনি কেউ বুঝে যাবে আপনার জীবনে সে অপরিহার্য তখনই আপনি হেরে গেলেন। একটি গভীরতম ভালোবাসার সম্পর্ক সেই মুহূর্তে হয়ে গেল অসম, পরাশ্রয়ী এবং পরনির্ভরশীল। সম্পর্কে ‘নির্ভরশীলতা’ খুবই দরকারি, কিন্তু এই বিশেষ 'পরনির্ভরশীলতা’র বেশির ভাগই সম্পর্কটাকে দুর্বল করতে শুরু করে।
তাহলে?
সম্পর্কের ভালো সময়টাতে হয়তো আপনি তা বুঝতে পারবেন না। বুঝতে পারবেন খানিক খারাপ সময়ে। দেখবেন কী কদাকার হয়ে উঠছে এই পরনির্ভরশীলতা!
তাহলে আবারও সেই একই কথা, নির্ভরশীল হতে হবে নিজের উপর। নিজের ভেতরে একটি শক্তিশালী স্বত্বা গড়ে তুলতে হবে, যে একলা থাকার ভয়াবহ দুঃসময়ে পরম মমতায় আগলে রাখবে আপনাকেই। স্বপ্ন দেখাবে নতুন দিনের, নতুন সম্ভাবনার। আপনার বুকের ভেতর শক্তি জোগাবে। সাহস জোগাবে। ধ্বংসের, মৃত্যুর, দুঃসময়ের ভয়ঙ্করতম ধ্বংসস্তূপ থেকেও সে আপনাকে জাগিয়ে তুলবে নতুন স্বপ্নে, সম্ভাবনায়, জীবনে।
পুড়ে যাওয়ার ছাই থেকে ফিনিক্স পাখীর পুনর্জন্মের মতন।
নিজের ভেতরের সেই শক্তি জাগিয়ে তুলবে আপনাকেই, আপনাকেই তৈরি করতে হবে আপনাকে, আপনিই তৈরি করবেন আপনার ভেতরের ফিনিক্স পাখিকে। আপনার জীবনেই শুরু হবে আপনার লেখা অন্য এক ফিনিক্স পাখির গল্প।
~ সম্পর্ক ভাবনা-২/ সাদাত হোসাইন
নোটঃ এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। যে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন    

কোন মন্তব্য নেই